Belief

করদাতাদের সম্মান করলেই বাড়বে রাজস্ব

সভ্যতার চরম উন্নতির যুগে এই শিরোনামে লেখা কলামটি কতটা গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চিন্তিত বটে! কিন্তু যখন মনের গভীর আবেগ থেকে তৈরি হওয়া যন্ত্রণার আগুন নেভানো প্রয়োজন হয়, তখন মানুষ যেমন আপনজনকে নিজের মনের কথা বলে বা লিখে কিছুটা হালকা হয়। তেমনি হয়তো বা এই লেখার কিছুটা সার্থকতা থাকতেও পারে।

করদাতার মনের কষ্টের কথাগুলো হলো– কর অফিসের লোকদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন, কথায় আছে “আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা”। কিন্তু এখন দেখা যায় “আয়কর আইনের যত ধারা, সব ধারাতেই করদাতারা খাবে ধরা”।

কর অফিসের কর্তারা সিন্দুক থেকে আইন বের করে হলেও হয়রানি করার কৌশল আবিষ্কার করে নেন। যেমনটি যুগ যুগ থেকে করা হতো। একসময় ব্রিটিশ শাসন আমলে, স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে ‘পিটুনি করের’ আইন ব্যবস্থা চালু করেছিল। এই পিটুনি করের ব্যবস্থাটি ছিল এরকম, “কোন বিধিনিষেধ আছে এমন ঘটনা ঘটার ৫০০ গজের মধ্যে থাকলে সবাইকে বেধড়ক পিটুনি খেতে হবে এবং পিটুনি খাওয়ার জন্য কর দিতে হবে। শুধু তাই নয়, পিটুনি দেওয়ার সময় যদি লাঠি ভেঙে যায়, তাহলে সেই লাঠির জন্যও জরিমানা দিতে হবে।” কী অবাক করার মতো কর পদ্ধতি!

কিন্তু আস্থার খবর হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছরেও এনবিআর পিটুনি করের কোনও এসআরও দেয়নি। তাহলে করদাতার মনের কষ্টগুলো কোথায়?

একটু দেখা যাক। একজন করদাতা অভিজ্ঞতা এরকম– একদিন তিনি তার নিজের একটা রিটার্ন নিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্কেলে গেলেন। অফিসে ঢুকতেই তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ অন্য একজন করদাতার সঙ্গে অফিসের কেউ চেঁচামেচি করছেন। আপনার এই নেই, সেই নেই, যান! এগুলো ঠিক করে নিয়ে আসেন, তারপর রিটার্ন জমা নেবো। তিনি একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে বললেন– “বাবারা আমি রিটার্ন নিয়ে আসছি, কোথায় দিবো?”

একজন কম্পিউটার অপারেটর বললেন– আমাকে দেন, পিয়ন টাইপের একজন বললেন– আমাকে দেন। সুপারভাইজার বললেন– একজনকে দিলেই হবে, ভালোভাবে চেক করে দেখ ঠিক আছে কিনা? তারপর কম্পিউটার অপারেটর নিলেন, ভালো করে পাতা উলটাতে লাগলেন, আর চোখে-মুখে বিরক্তি দেখাতে থাকলেন। আপনি এটা কি নিয়ে আসছেন? আপনার এনআইডি, টিআইএন মূল কপি দেখান, আয় এত কম কেন, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। অথচ এগুলো একটাও বলার কোনও প্রয়োজন নেই।

অনেক করদাতার অভিযোগ– আয়কর অফিসে গেলেই মক্কেল এসেছে ভেবে অনেক আইনকানুনের ভয় দেখানো হয়। স্যার নেই, কাল আসেন, আপনার রিটার্ন ভুল আছে, সঠিক নেই, আপনার আয় এত কম দেখিয়েছেন, স্যারের কাছে গেলে ধরবে, আপনার ইটিআইএন খুলেছেন অনেক আগে, রিটার্ন জমা দেন নাই– অনেক টাকা জরিমানা হবে, এই কথাগুলো কমন কথা।

যেমন– রাজনীতির মাঠের কিছু মুখস্থ বুলির মতো। এগুলো না বললে কর অফিসের লোকজনের পেটের ভাত হজম হয় না। পিয়ন থেকে সুপারভাইজার বা দুই একজন ডিসিটি পর্যায়ের কর্মকর্তা এই আচরণ করেন বলে অভিযোগ আসে।

এছাড়া কোনও রকম রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকার নিয়ে আসলেও ভয় কাটছে না। কিছু দিন পরপর ফোন করে দেখা করতে বলা, কখনও কখনও চিঠি দিয়ে বিশাল জরিমানার ভয় দেখানো ইত্যাদি অভিযোগ আছে কর অফিসের বিরুদ্ধে।

কর আদায় ব্যবস্থাপনার আদি ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতার মানদণ্ড তুলনা করতে গেলে দেখা যায়. মানুষগুলোর পরিবর্তন হলেও আচরণ বা রীতিনীতির বা পদ্ধতি উন্নতি বলতে চেয়ার-টেবিল ও অফিসের সাজসজ্জার পরিবর্তন ছাড়া বাকি সবই অবনতি। এই চিত্রটি সব কর অফিসে আছে এমন নয়। তবে অধিকাংশই চিত্রই প্রায় একই রকম।

এর নেতিবাচক দিক হলো– করদাতারা দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক, তারা কর অফিসে অসম্মানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসবেন তা কাম্য নয়। এর নানা নেতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন– করদাতারা কর দিতে নিরুৎসাহী হচ্ছেন, করযোগ্য অনেক করদাতা কর অফিস এড়িয়ে যাচ্ছেন, কর-ফাঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দেশের রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

কর্তৃপক্ষের করণীয় কী করতে পারে?

প্রতিটি কর-সার্কেলে করদাতাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলো ভেবে দেখতে পারে–

১. করদাতা বা তার প্রতিনিধি কর অফিসে গেলেই আন্তরিকতার সঙ্গে কুশল বিনিময় করা;

২. ইতিবাচক অভ্যর্থনা দিয়েই কাজের পরিবেশ তৈরি করা;

৩. রিটার্ন বা তৎসংশ্লিষ্ট কোনও বিষয় নিয়ে গেলে তা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা ও তা বুঝিয়ে বলা;

৪. করদাতার সঙ্গে কোনও বিরূপ আচরণ না করা;

৫. কোনও ঘাটতি থাকলে তা বুঝিয়ে দেওয়া;

৬. জোরপূর্বক বকশিশ বা কোনও সম্মানি আদায় না করা;

৭. রিটার্নের প্রাপ্তি স্বীকার একই দিনে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে দিয়ে দেওয়া;

৮. রিটার্নের প্রাপ্তি স্বীকার সহজীকরণ করা, যেমন যিনি রিটার্ন গ্রহণ করবেন, তিনিই স্বাক্ষর করলে প্রাপ্তি স্বীকার রসিদ গ্রহণযোগ্য হবে এমন সার্কুলার দেওয়া (অনলাইনে স্বাক্ষর ছাড়াই তা গ্রহণযোগ্য)। এতে করদাতার অনেক সময় বাঁচবে এবং কর অফিসের প্রতি করদাতার আস্থা তৈরি হবে।

আমাদের চিন্তায়, চেতনায় ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা জরুরি। তাহলে রাজস্ব আদায়ে নানান অসুবিধা থাকলেও ইতিবাচক কিছু করা সম্ভব হবে। না হলে রাজস্ব আদায়ে বারবার নিম্নমুখী সূচকের ভার বহন করা কঠিন হবে।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

 




Source link

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

You cannot copy content of this page

en_GBEnglish