Belief

ফিলিস্তিনের প্রশংসা করে ইসরায়েলকে সহায়তা

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ এবং ইসরায়েলি হামলার জবাবে ফিলিস্তিনিদের প্রশংসা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এদিকে, আবার তিনিই গাজায় অমানবিক আগ্রাসন চালানো ইসরায়েলকেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করে আসছেন। তাই, তুর্কি প্রেসিডেন্টের এই দ্বিচারিতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন মধ্যপ্রাচ্যে এ কোন দ্বৈত খেলায় মেতে উঠেছেন এরদোয়ান?

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এরদোয়ানের বক্তব্য মনোযোগ দিয়েই শুনেছিলেন সবাই। কেননা, তারা ভেবেছিলেন, তুরস্ক-ইসরায়েলের মধ্যে কোনও বিরোধ আছে। তাই ফিলিস্তিনিকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবেন এরদোয়ান। কেননা, বিশ্বজুড়ে খুব কম দেশই আছে যারা ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে। আর সে দেশগুলোরই একটি তুরস্ক।

৭ অক্টোবর ‘অপারেশন আল-আকসা’ এবং গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পর দেশটিকে একটি ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এরদোয়ান। তার এমন মন্তব্যে বাঁক নিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ইস্যু।

১২ নভেম্বর ইসরায়েলকে একটি ‘শিশু-হত্যাকারী’ দেশ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এরদোয়ান। এমন মন্তব্যের তিন দিন পরই তার দলীয় সম্মেলনে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, এ কথা আমি স্বজ্ঞানে বলছি, ইসরায়েল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।

ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার দায়ে দোষী এরদোয়ানের বক্তব্যে তা একদম পরিষ্কার ছিল। এর আগে, ২০১৭ ও ২০১৮ সালেও একই কথা বলেছিলেন তিনি।

এদিকে, ইসরায়েলের নিন্দা করলেও হামাসের প্রশংসা করেন এরদোয়ান। তিনিই আবার গোষ্ঠীটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন বলে পশ্চিমাদের কাছে অভিযোগ করেন। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস একটি রাজনৈতিক দল। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার জন্য এটি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল। পরে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গাজায় ক্ষমতা দখল করে গোষ্ঠীটি।

এছাড়াও, পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর অংশীদারদের প্রতি কটাক্ষ করে ইসরায়েলি প্রশাসনকে অভিশাপও দিয়েছিলেন এরদোয়ান। তিনি বলেছিলেন, ন্যাটো অংশীদাররা প্রকাশ্যে ইসরায়েলি গণহত্যাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের কথা উল্লেখ তিনি বলেন, একটি গণহত্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে গাজা।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের শুরুতে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন এরদোয়ান। তখন বেসামরিকদের জীবন রক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

তবে ইসরায়েলি নৃশংসতার মর্মান্তিক কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা তুর্কি জনসাধারণের হৃদয়ে নাড়া দেয়।  গাজা ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে তাদের অনুভূতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। তখনই এরদোয়ান গাজার জন্য কথা বলতে শুরু করেন।

তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দল ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করেন। সেই আন্দোলনে উজ্জীবিত হন এরদোয়ান। তারপর দখলদার রাষ্ট্রের গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শুধু নেতৃত্বই দেননি, বরং ইসরায়েলের সমর্থকদের সমালোচনাও করেছেন তিনি। কৌশলগতভাবেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন এরদোয়ান। এমনকি তাকে তৎকালীন জার্মান চ্যানসেলর অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গেও তুলনা করেছেন তিনি।

তবে এরদোয়ানের মুখের কথা আর বাস্তবতা এক বিন্দুতে এসে মেলেনি। তার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।  গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে  দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলেছেন তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু। তার সমালোচনা করে  আহমেত দাভুতোগলু প্রশ্ন করেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার যদি নিন্দাই করবেন এরদোয়ান, তবে ইসরায়েলকে কেন তেল ও বিমানের জ্বালানি সরবরাহ করছেন তিনি?

এই প্রশ্নের জবাবে এরদোয়ান বলেছিলেন, আমরা ইসরায়েলের কাছে ঋণী নই। তার এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দাভুতোগলু্। তবে এই জবাবে সন্তুষ্ট হহতে পারেননি তিনি। তিনি প্রশ্ন  তুলেন তুরস্কি যদি ইসরায়েলের কাছে ঋণী না হয় তবে সেহান বন্দর থেকে ইসরায়েলে কেন তেলের চালান অব্যাহত রাখা হবে? কেন তুরস্ক থেক ইসরায়েলি বিমানের জন্য জ্বালানি সরবরাহ করা হয়? ইসরায়েলি সেনাদের জন্য খাদ্যও পাঠানো হয়? এটা আপনার লজ্জাজনক! লজ্জাজনক!

এদিকে, কাজাখস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে ৩ নভেম্বরে এরদোয়ান বলেছিলেন, হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষে গাজাকে অবশ্যই স্বাধীন ফিলিস্তিনের অংশ হতে হবে। তিনি বলছিলেন, ‘ইতিহাস থেকে ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলার’ মডেলকে তিনি কখন সমর্থন দেবেন না। এছাড়া, ২০ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার বৈঠকের সময় ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন তিনি।

ইসরায়েলে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করার প্রতিক্রিয়ায় ৩ নভেম্বর এরদোয়ান ঘোষণা করেছিলেন, নেতানিয়াহু কেউ নন, যার সঙ্গে আমরা কথা বলতে পারি।

রক্ষণশীল বিরোধী সাদেত পার্টির একজন আইন প্রণেতা সংসদ সদস্য হাসান বিটমেজ। ১৪ ডিসেম্বর সংসদের মঞ্চে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করার জন্য এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (একেপি)-এর নিন্দা করেছিলেন তিনি।  হাসান বিটমেজ বলেছিলেন, এরদোয়ানের হাতে ফিলিস্তিনিদের রক্ত লেগে আছে। গাজায় ইসরায়েলের প্রতিটি বোমায় অবদান রয়েছে তার।

এই কূটনৈতিক অস্বীকৃতির মধ্যেও তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ডিসেম্বরে ইসরায়েলে তুরস্কের রফতানি ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। নভেম্বরে ৩ হাজর ১৯৫ লাখ মার্কিন ডলার থেকে ডিসেম্বরে চার হাজার ৩০৬ লাখ ডলার হয়েছে। যা সংঘাতের আগের চেয়ে বেড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলে তেল ও খাদ্য রফতানি বন্ধ করার আহ্বান জানায় ইরান। তারপরও ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত স্বার্থ বজায় রাখতে অটল রয়েছে তুরস্ক।
পশ্চিম এশিয়া সফরের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন তিনি। এই সফরের লক্ষ্য ছিল, ইসরায়েলের শান্তি, ফিলিস্তিনির নেতৃত্বে পশ্চিম তীর ও গাজা একীকরণ ও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
অধিকৃত ফিলিস্তিন যুদ্ধের বিষয়ে তুরস্কের অবস্থানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণ রয়েছে। যা অনেক জটিল। এর পেছনে রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা বৈদেশিক নীতি।
এছাড়া, ২০১৮ সাল থেকে অর্থনৈতিক সংকট, জাতীয়তাবাদের উত্থান, পশ্চিম এশীয় অঞ্চলে বৈশ্বিক শক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া) প্রভাব, এরদোয়ান ও পশ্চিমাদের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক এবং তুরস্কের কৌশলগত স্বাধীনতা।
গত বছর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল তুরস্ক। তুর্কি মুদ্রা লিরার ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন এবং ৬২ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল। লিরা ও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি মোকাবিলার জন্য ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস করা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছিল।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর নভেম্বরের প্রথম দিকে তুরস্কে পরিচালিত একটি মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অর্থনীতি তুরস্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তারপরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ বেকারত্ব। একই জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতারা মনে করেন, ২০২৪ সালে তুরস্কের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
মজার বিষয় হল, গাজার সমস্যা নিয়ে তুর্কি জনমত জরিপে কিছু ছিল না। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার আগ্রহ আছে।
অভ্যন্তরীণভাবে জাতীয়তাবাদী মনোভাব গত কয়েক বছরে গতি পেয়েছে। যেটি সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট। মূলত ব্যর্থ সিরিয়া পররাষ্ট্রনীতির কারণেই এমন হয়েছে।
যাই হোক না কেন, তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের অগ্রাধিকার রাষ্ট্র, জাতি নয়। তাই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার সম্পর্কের বিরোধিতা করতে পারেন না তারা। সাম্প্রতিক একটি জরিপ দেখা গেছে, হামাসের প্রতি খুবই কম সংখ্যক সমর্থক আছেন। নিরপেক্ষ অবস্থানে আছেন সংখ্যাগরিষ্ঠরা।
১৯৪৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র হলো তুরস্ক। স্বীকৃতি পাওয়ার এক বছর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের মিত্র হিসেবে কাজ করছে ইসরায়েল।
যদিও এরদোয়ান এই অঞ্চল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের ভূ-রাজনীতির পরিবর্তন সম্ভাবনা খুবই কম। তার স্বাভাবিক অবস্থান পশ্চিম দিকেই। বিশেষ করে যখন অর্থ সংকটে থাকে।




Source link

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

You cannot copy content of this page

en_GBEnglish